দুর্গেই দিশাহারা ফখরুল-মান্না

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এলাকা বগুড়া বিএনপির দুর্গ হিসেবেই পরিচিত। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভোটে লড়তে না পারায় এখানে হেভিওয়েট প্রার্থী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। খবর দৈনিক আমাদের সময় এর।

দুজনই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। অন্যদিকে জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে দুটি বাদে বাকিগুলো মহাজোটের শরিকদের ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে নিজেদের দুর্গেও নির্বাচনের মাঠে সরব হতে পারছেন না ধানের শীষের প্রার্থীরা। শঙ্কা রয়েছে ভোটারদের মধ্যেও। বগুড়া-২ ও ৬ আসন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

বগুড়ার একটি আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী না থাকায় বিপাকে পড়েছে বিএনপি। তবে দুটি আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মাহমুদুর রহমান মান্না সবার

নজর কেড়েছেন। উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রখ্যাত বগুড়া-৬ (সদর) আসনটি নির্ধারিত ছিল খালেদা জিয়ার জন্য। কিন্তু তিনি প্রার্থী হতে না পারায় লড়ছেন মির্জা ফখরুল। তার সঙ্গে লড়ছেন মহাজোট প্রার্থী জাপা নেতা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর। এর মধ্যে ফখরুল দুদিন উপস্থিত থেকে প্রায় ৪০টি এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেছেন। তবে দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, পুলিশি তৎপরতায় তারা পুরোদমে প্রচার চালাতে পারছেন না।

জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুুল ইসলাম বলেন, ‘দলের মহাসচিবকে বিজয়ী করতে আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গণসংযোগ, পথসভা, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করছি। তবে পুলিশের মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতাকর্মীরা বের হতে ভয় পাচ্ছেন।’ মহাজোটের প্রার্থী নুরুল ইসলাম ওমর অবশ্য বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত আমার পথসভায় হামলা করে নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়। ভোটারদের প্রতি আমার অনুরোধ- লাঙল মার্কায় ভোট দিয়ে বগুড়ার ভোট বগুড়াতেই রাখুন। এখানকার মানুষের কাছে যার কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তাকে নির্বাচিত করলে উন্নয়ন হবে না। অতীতে বগুড়াবাসী তার প্রমাণও পেয়েছে। তাই কোনো বিশেষ প্রতীকের মোহে অন্ধ হয়ে না থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করুন।’

এ আসনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আবু নুমান মো. মামুনুর রশীদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আমিনুর রহমান টিপু, কমিউনিস্ট পার্টির আমিনুল ফরিদ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) জীবন রহমান ও জাকের পার্টির ফয়সাল বিন শফিকও প্রচার চালাচ্ছেন।

আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন রাজধানী দুর্গনগরী মহাস্থানগড়খ্যাত বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ মাহমুদুর রহমান মান্না। এর আগেও তিনি এ আসনে তিনবার প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। তবে এবার মার্কা বদল করে এসেছেন। মানুষের মাঝে তাকে নিয়ে আগ্রহও ব্যাপক। এ পর্যন্ত তিন দফা এলাকায় এসে পথসভা, গণসংযোগ সভা-সমাবেশ করেছেন। তবে চোখে পড়ার মতো নির্বাচনী প্রচার নেই তার। এলাকায় থাকলে কিছুু নেতাকর্মী তার সঙ্গে ভোট চাইতে বের হন, আবার চলে গেলে পুলিশের ভয়ে সবাই নিশ্চুপ। সরেজমিন উপজেলার কয়েকটি স্থানে কিছু পোস্টার এবং কোথাও কোথাও মাইকিং হতে দেখা যায়। তবে যেসব নেতাকর্মী দিনে ঘুরে ঘুরে ভোট চান, রাতে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। গত ১৫ দিনে প্রায় ৭৫ নেতাকর্মীর নামে নতুন করে দুটি নাশকতার মামলা দেওয়া হয়েছে।

গত শুক্রবার দুপুরে শিবগঞ্জ বাজারে গিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্নার পোস্টার দেখা গেলেও লাঙলেরই বেশি। কথা হয় দুজন ভোটারের সঙ্গে। তারা বলেন, এটি বিএনপির ঘাঁটি। স্বাভাবিকভাবে ধানের শীষ প্রার্থীরই পাস করার কথা। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না। এবারের ভোট একপেশে। কারও মধ্যেই উৎসব-উৎসাহ নেই। ভোটকেন্দ্রিক আড্ডাও অনেক কম।

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এলাকায় ধানের শীষের কোনো পোস্টার রাখা হচ্ছে না। মহাজোটের লাঙল মার্কার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা ট্রাক ভাড়া করে নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ঘুরে আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। শিবগঞ্জের নাগরবন্দরে অবস্থিত ধানের শীষের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় ছাড়াও মোকামতলা ও চ-িহারায় নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশ মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি কাজ করছে। মহাজোট প্রার্থী নিজেও বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় বলছেন, শিবগঞ্জে ধানের শীষের কোনো পোস্টার থাকবে না। ধানের শীষের প্রার্থীকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

শিবগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম বলেন, ‘প্রতিদিন রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েও বিএনপি নেতাদের খোঁজ করছে পুলিশ। জামিনে থাকা আসামিকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার করছে। কর্মীদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এতকিছুর পরও আমরা ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

মহাজোটের প্রার্থী জাপা নেতা সাংসদ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ গোটা এলাকাই চষে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে থাকছেন নিজ দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী। গতবারের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে ফের ভোট চাইছেন। জিন্নাহ বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছি। প্রতিদিন বেশ কয়েকটি সভা ও পথসভায় যোগ দিচ্ছি। সর্বত্রই অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি।’ এ আসনের অন্য প্রার্থী ইসলামী আন্দোলনের মো. জামাল উদ্দিন ও মুসলিম লীগের শফিকুল ইসলামও প্রচার চালাচ্ছেন জয়ের আশা নিয়ে।

এ ছাড়া বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্তমান সাংসদ আবদুল মান্নান। প্রতীক বরাদ্দের পর নৌকা নিয়ে সরব। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী বিএনপির কাজী রফিকুল ইসলাম। তবে প্রচারের মাঠে তাকে খুব একটা দেখা যায়নি। ধানের শীষের পোস্টার নেই তেমন।

বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া) আসনে বিএনপির নতুন মুখ মাছুদা মোমিন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদ নুরুল ইসলাম তালুকদার। বিএনপির প্রার্থিতা নিয়ে জটিলতার সুযোগে তিনি অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন।

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাসদ নেতা বর্তমান সাংসদ রেজাউল করিম তানসেন এবারও প্রার্থী হয়েছেন। আর বিএনপির প্রার্থী নতুন মুখ মোশারফ হোসেন। বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাংসদ হাবিবর রহমান এবং বিএনপির গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ।

জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে লাঙল নিয়ে লড়ছেন মহাজোটের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ মুহাম্মদ আলতাফ আলী। এখানে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হলে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে গাবতলী উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ মিলটনকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরে তার প্রার্থিতা বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন কমিশনে আপিলে অবশ্য তা ফিরে পান। তবে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মিলটনের প্রার্থিতা স্থগিত করে দেন হাইকোর্ট। এখন আসনটি ধানের শীষ প্রার্থীশূন্য। তাই হতাশায় ডুবেছেন সমর্থকরা।

সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়